ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ইতিহাস আলোচনা কর।
“এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সব তুচ্ছ ভয়”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ত্রাণ)
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার ছোঁয়ায় এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে’ অনেক ‘তুচ্ছ ভয়’ দুর হয়েছিল। ভারতীয় সমাজে সমাজসংস্কারমূলক কর্মসূচি কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম অথবা বাংলার নবজাগরণের পেছনে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার অনেকখানি সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল। এক সুদীর্ঘ পটভূমিতে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে দোদুল্যমানতাঃ ভারতে আসা মিশনারিগণ সরকারি উদ্যোগে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন উচিত কিনা তা নিয়ে প্রথমদিকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল। কারণ এই সময় তারা দুটি পরস্পর বিরোধী ধারণার দ্বারা চালিত হচ্ছিল। যেমন-
(১) একদল খ্রিস্টান মিশনারি মনে করত যে ভারতীয়রা অসভা ও বর্বর। তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে গেলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। ফলে এদেশে ব্যাবসাবাণিজ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
(২) অপর দল খ্রিস্টান মিশনারিগণ মনে করত জিশুর আদর্শ অনুসারী অশিক্ষিত ভারতীয়দের শিক্ষিত করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। আর তাহলে তাদের খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও ব্যাবসা বুদ্ধি আরও সহজতর হবে।
সরকারের দোলাচলতার অবসান : ভারতে শিক্ষাবিস্তারে ঔপনিবেশিক সরকারের দোলাচলতার অবসান ঘটে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে। জনমতের চাপে এই আইনে (৪৩ নম্বর ধারা) ভারতে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘদিন পরে ভারতে সরকারি উদ্যোগে শিক্ষাবিস্তার শুরু হয়। মনে রাখা দরকার যে, এর পূর্বে ভারতে বেসরকারি উদ্যোগে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছিল।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন: গভর্নর জেনারেল মিন্টো তাঁর একটি রিপোর্টে (১৮১০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতে শিক্ষার শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরে ভারতীয় শিক্ষার জন্য কোম্পানির কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানান। এরপর ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের একটি ধারায় বলা হয় কোম্পানি প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। এদেশের জনশিক্ষার জন্য, সরকারিভাবে ভারতে শিক্ষাবিস্তারের এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ।
শিক্ষার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ : ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নতি বলতে কোন্ সাহিত্য অর্থাৎ ভারতীয় না ইউরোপীয় তা স্পষ্ট করে বলা ছিল না। বিজ্ঞানের উন্নতি বলতে কোথাকার বিজ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে তারও স্পষ্ট উল্লেখ সনদ আইনে ছিল না। ফলে শিক্ষাধারার ব্যাখ্যা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।
কমিটি আফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ গঠন ঃ সরকারিভাবে ঘোষিত একলক্ষ টাকা কিভাবে খরচ করা যেতে পারে এবং ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্য নিয়ে অস্থায়ী গভর্নর মিস্টার এডামের সময়ে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই GCPI বা ‘কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ গঠিত হয়। সপারিষদ বড়োলাট দশজন সদস্য নিয়ে এটি গঠিত হয়। এই শিক্ষাসভার উদ্দেশ্য নিয়ে বলা হয় ভারতীয়দের জন্য উন্নত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার প্রবর্তন এবং তাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিসাধনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জন হেরিংটন এই শিক্ষাসভার প্রথম সভাপতি ও ডা. হোরেস উইলসন ছিলেন এর প্রথম সম্পাদক।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের দ্বন্দ্ব : শিক্ষাসভান (কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন) কিছুদিন কাজ করার পর বড়োলাট বেন্টিঙ্কের আমলে এর কিছু পরিবর্তন আসে। এই সময় টমাস ব্যাবিংটন মেকলে কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে সভার দশজন সদস্যের মধ্যে পাঁচজন প্রাচ্যবিদ্যাকে সমর্থন করতে থাকে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এইচ.টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক ও উইলসন। এরা প্রতিবাদী নামে পরিচিত হন, আর বাকি পাঁচজনের অধিকাংশই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কোলভিন প্রমুখ এঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত ছিলেন।
প্রাচ্যবাদীরা মনে করতেন ভারতের ঐতিহ্যপূর্ণ সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটানো তাঁদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ এতে ভারতীয়দের মন জয় করা যাবে। তা ছাড়া শিক্ষাধারার নির্দেশও সেইরকম বলে তারা মনে করত। তারা মনে করত সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন বলতে প্রাচ্যবিদ্যাকেই বোঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে পাশ্চাত্যবাদীরা মনে করতেন, সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন বলতে ইংরেজি সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। তাঁরা আরো বলেন দেশের লোক পাশ্চাত্য শিক্ষাকেই বেশি পছন্দ করছে। কারণ শিক্ষাসভার মুদ্রিত সংস্কৃত ও আরবি বইগুলির কোনো বিক্রি নেই। অথচ ইংরেজিতে ছাপা বইগুলি ছাপা হওয়ার সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। রামমোহন ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর লর্ড আমহার্স্টকে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত জানিয়ে যে পত্র পাঠিয়েছিলেন, তাও পাশ্চাত্যবাদীদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এইভাবে কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সদস্যরা দুইটি দলে (প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী) বিভক্ত হয়ে যায়। উভয়ই নিজ নিজ যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের এই দ্বন্দ্ব প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।
- বেন্টিঙ্ক ও মেকলে মিনিট : বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় (১৮২৫-১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ) সরকারি শিক্ষানীতিতে এক পরিবর্তন আসে। ইংল্যান্ডে উদারনৈতিক দলের প্রভাবে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইন পাস হয়। এইসময় শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থ একলক্ষ পাউন্ড করা হয়। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মেকলে বড়োলার্টের আইন পরিষদে যোগ দেয়। বেন্টিঙ্ক তাঁকে শিক্ষাসভার সভাপতি নিযুক্ত করেন। এইসময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকর্মীরা তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের অবসানের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। বড়োলটি মেকলের অভিমত চেয়ে পাঠায়।
- মেকলে মিনিট ঃ মেকলে শিক্ষাধারার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিখ্যাত ‘মিনিট’ বা মন্তব্য পেশ করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার আবশ্যিক এবং এই বিষয়ে সরকারের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। বেন্টিঙ্কের মতকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কমিটির নবনিযুক্ত সদস্য আলেকজান্ডার ডাফ এবং তাঁর পরিষদের আইনসদস্য লর্ড মেকলে। এঁরা দুজনেই ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী। মেকলে কে পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কমিটির সভাপতি নিয়োগ করেন বেন্টিঙ্ক। মেকলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রসারের স্বপক্ষে বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন (১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। এই প্রতিবেদন মেকলে মিনিট নামে খ্যাত। তিনি বলেন কিছু ভারতীয়কে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিলে, তাদের মাধ্যমে আরও বহু ভারতীয় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। অর্থাৎ, সীমিত সংখ্যক পাশ্চাত্য শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে ইংরেজি শিক্ষা জনগণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। মেকলের এই নীতি ফিলট্রেশন থিয়োরি নামে পরিচিত। মেকলের উদ্দেশ্য ছিল একদল ইংরেজি শিক্ষিত দেশি সাহেব সৃষ্টি করা। ভারতবর্ষের সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি মেকলের তীব্র ঘৃণা ও নীচু ধারণা ছিল। তিনি দম্ভভরে বলেছিলেন, এক আলমারি পাশ্চাত্য পুস্তক থেকে যে জ্ঞান অর্জন করা যায়, প্রাচ্যের সমস্ত লাইব্রেরি ঘাঁটলেও তা পাওয়া যাবে না। যাইহোক, মেকলের প্রতিবেদন পরিণামে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার খুলে দেয়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ তাঁর এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন পায়। অতঃপর সরকারি উদ্যোগে ও আর্থিক সাহায্যে ভারতে পাশ্চাত্য ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত প্রসার ঘটে। ওই কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং বোম্বাইতে এলি কলেজ স্থাপিত হয়।
অ্যাডামের রিপোর্ট : ইতিমধ্যে জনৈক স্কটল্যান্ডসাম। অ্যাডাম নিজে উদ্যোগ নিয়ে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কারে। চিঠি লিখে জানান যে, তিনি দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। দ্বিতীয় অনুরোধ মঞ্জুর (১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ) হওয়ায় তিনি বাংলার অনুসন্ধান করতে রাজি আছেন (১৮২৯ খ্রিস্টাব্দ)। অ্যামের তাঁর অনুসন্ধান কাজ শুরু করেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই। অ্যাডাম তাঁর প্রথম রিপোর্ট জমা দেন।
বেন্টিঙ্কের সিদ্ধান্ত : বড়োলার্ট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেকলের সুপারিশগুলিকে মানাতা প্রদান করেন। এরপর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ তিনি তাঁর কিছু গ্রহণের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার ও প্রসার সরকারি নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এভাবে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পথ খুলে যায়।
উডের ডেসপ্যাচ : ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই বোর্ড অফ কন্ট্রোল-এর সভাপতি স্যার চার্লস উড শিক্ষাসংক্রান্ত যে নির্দেশনামা প্রকাশ করেন, তা উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত। এই কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল—
(১) শিক্ষা প্রসারের জন্য পৃথক শিক্ষা দফতর প্রতিষ্ঠা দরকার।
(২) কলকাতা, মুম্বাই, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।
(৩) মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নারীশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি দরকার।
(৪) শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।
(৫) বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি সাহায্য বা অনুদান দিয়ে হবে।
(৬) ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
(৭) দেশীয় ভাষা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বিস্তার প্রয়োজন।
ফলাফল : উডের সুপারিশ অনুসারে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি শিক্ষা দফতর খোলা হয়। এ ছাড়া উত্তের সুপারিশ অনুসারে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বই প্রেসিডেন্সিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অনুদান পায় এবং ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটে। অনেকে উত্তের ডেসপ্যাচকে ‘ম্যাগনা কার্টা অফ ইংলিশ এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার : ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে তার একটি হাদিস পাওয়া যায়। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের এক সুদূরপ্রসারী ও গভীরতর অভাব ভারতীয় সংস্কৃতিতে পড়েছিল।
এছাড়া দেখে নাওঃ
জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? আনন্দমঠ’ উপন্যাস কীভাবে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে?